বাংলাদেশে শীত এলেই শুরু হয় খেজুরের রস সংগ্রহ এবং সেই রস থেকে বিশেষ উপায়ে তৈরি হয় খেজুরের গুড়। দেশের সবচেয়ে বেশি আলোচিত, সুস্বাদু ও দামি হাজারী গুড় তৈরি হয় মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকায়। স্বাদ আর গন্ধে এই গুড়ের জুড়ি মেলা ভার। যার সুখ্যাতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে বহু দূরে।
মানিকগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে এই গুড়ের নাম। লোকসংগীত আর হাজারী গুড়, মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর। জেলার ঐতিহ্য বহন করায় এভাবেই হাজারী গুড়ের নামে মানিকগঞ্জ জেলাকে ব্রান্ডিং করা হয়েছে। জেলার হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকার ৩০ থেকে ৩৩টি গাছি পরিবার এই ঐহিত্য ধরে রাখতে চেষ্টা করছেন।
হাজারী পরিবার সূত্রে জানা যায়, বহুবছর আগে উপজেলার বাল্লা ইউনিয়নের ঝিটকা শিকদার পাড়া গ্রামে মো. হাজারী নামে এক ব্যক্তি এই গুড়ের প্রবর্তক। তার নামানুসারেই এই গুড়ের নাম হয়েছে হাজারী গুড়। প্রথম কাটার খেজুর রস দিয়ে তৈরি হয় হাজারী গুড়। আগের দিন বিকালে খেজুর গাছের ছাল কেটে বেঁধে দেওয়া হয় হাঁড়ি। তারপর ভোর বেলায় সেই রস সংগ্রহ করে জ্বাল দিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি হয় হাজারী গুড়। এক কেজি হাজারী গুড় তৈরি করতে প্রয়োজন হয় ১২ কেজি রসের। প্রতিকেজি গুড় বিক্রি হয় ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকায়।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে মোট ৮৮৮৬টি খেজুর গাছ রয়েছে। যার ভেতরে ৫০৮৬টি গাছ রস সংগ্রহ করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এই রস থেকেই তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়। গতবছর হাজারী গুড় উৎপাদন হয় ১২ হাজার কেজি যার বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি টাকারও বেশি। আবহাওয়া খারাপ থাকায় এ বছর ৮ থেকে ৯ হাজার কেজি হাজারী গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা।
উৎপাদিত গুড় কেনাবেচা হয় উপজেলার হাটগুলোতে। সেখান থেকে কিনে পাইকাররা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করে। এ গুড় বর্তমানে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। অর্জন হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। উপজেলার গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে স্থানীয় এ পণ্যটি।
সরজমিনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে যানা যায়, আগে খেজুর গাছ বেশি থাকায় অনেক গুড় উৎপাদন হতো। দিন দিন খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় গুড় উৎপাদন কমে গেছে। কারণ হাজারী গুড় হয় খেজুর গাছের রস থেকে। গাছিরা বলেন, আবহাওয়া ভালো থাকলে প্রতি গাছি বছরে প্রায় ৩০০ কেজি গুড় উৎপাদন করতে পারে। যার দাম প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মতো হবে।
উপজেলা ঝিটকা শিকদার পাড়া গ্রামের গাছি মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমরা যারা হাজারী গুড়ের কারিগর আছি তারা বছরে প্রায় ৩০০ কেজি হাজারী গুড় তৈরি করে থাকি এবং প্রতিকেজি হাজারী গুড় বিক্রয় করি ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা কেজি। এছাড়াও লাল পাটালি এবং ঝোলা গুড়ও বিক্রয় করি এতে দেখা যায় সবমিলিয়ে প্রতি গাছি প্রায় ৭ লাখ টাকার গুড় বিক্রি করি। এছাড়াও গাছ, গাছি ও জ্বালানি দিয়ে মোট খরচ হয় প্রায় ৪ লাখ টাকা। বছর শেষে আমাদের অনেকের দুই, আড়ায় অথবা তিন লাখ টাকা লাভ থাকে।
উপজেলার অন্যতম হাজারী গুড়ের বাজার ঝিটকা বাজারের গুড় বিক্রেতা মো. রহিজ হাজারী জানান, প্রতিদিনই এই বাজারে গুড়ের হাট বসে। প্রতি হাটেই লাখ লাখ টাকার গুড় বেচাকেনা হয়। তারপর এ গুড় বিভিন্ন বড় বড় বাজারে পাইকাররা নিয়ে বিক্রি করে। আমাদের আড়ৎ থেকে গুড় কিনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদেশে হাজারী গুড় পাঠায়। হাজারী গুড় প্রতি কেজি ১৬০০ থেকে ১৮০০ দরে বিক্রি হচ্ছে। আমি ছাড়াও আরও অনেকেই এই হাটে গুড় বিক্রি করেন।
এ বিষয়ে শামিম হাজারী বলেন, আমাদের বংশে মো. হাজারী নামের একজন ব্যক্তি ছিলেন যার নাম অনুসারেই এই গুড়ের নামকরণ করা হয়। আমি তার ৬ষ্ঠ জেনারেশন। প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ বছর আগের ঘটনা। রাণী এলিজাবেথও এই গুড় খেয়ে প্রশংসা করেছে। বর্তমানে ২৭ থেকে ৩০ জন গাছি এই হাজারী গুড় বানায়। আমাদের বংশেরও ৩ থেকে ৪ জনে এই গুড় বানায়। আমাদের পরিবার ছাড়াও যারা গুণগত মান ঠিক রেখে এই গুড় তৈরি করতে পারে তাদেরকে গুড় বানানোর সিল এবং অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. তৌহিদুজ্জামান খান বলেন, মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ঝিটকার হাজারী গুড় খুবই সুস্বাদু। শীতের নানান পিঠাপুলি তৈরিতে এর জুড়ি নেই। এজন্য বিদেশেও পাঠানো হয় এই গুড়। প্রতিবছরের মতো এবারও গুড়ের ভালো দাম পাচ্ছেন গাছিরা। ফলে উপজেলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে এখন চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে উপজেলার হাট-বাজারগুলোতে বিক্রির পাশাপাশি শিক্ষিত যুব-সমাজ অনলাইনে গুড় বিক্রি করছে। সবমিলিয়ে হরিরামপুরে খেজুর গুড়ে এবার প্রায় ২ কোটি টাকারও বেশি বেচাকেনা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।